এক ভাষা সেনাপতির কথা!

এক ভাষা সেনাপতির কথা!

এক ভাষা সেনাপতির কথা | ইন্দ্রনীল মজুমদার

আজ আমরা এমন একজনকে নিয়ে আলোচনা করব যিনি ছিলেন বলা যায় আদ‍্যন্ত গণ আন্দোলনের একজন সৈনিক। বলব- এক ভাষা সেনাপতির কথা! তৎকালীন সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন বারবার। সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে তাঁর অবদান কোনোদিনও ভুলে যাওয়ার নয়। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে এই মানুষটি আজকের দিনে বিস্মৃতপ্রায়। বাঙালি জাতি মনে রাখেনি তাদের এই আপনজনকে।

সংসদীয় রাজনীতিতে তাঁর কোনোকালেই খুব একটা ভরসা ছিল না। অথচ সংসদে বাংলা ও বাঙালির মুখ ছিলেন তিনি। আসলে তিনি বাংলা ভাষা সৈনিকও বটে! তাঁর নাম মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। সকলে তাঁকে চেনে মাওলানা ভাসানী হিসেবে। গণ আন্দোলনের এই বিশিষ্ট সৈনিক তাঁর হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন কিছুটা হলেও ‛কমিউনিজম’-কে। আর তাই তিনি পরিচিত ছিলেন ‛লাল মাওলানা’ নামে।বাল্যকালে অবশ্য নাম ছিল ‘চোগা মিয়া’

১৯১৯ সালে খিলাফত আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন এবং কারারুদ্ধ হয়েছিলেন। সেখান থেকে ছাড়া পেয়ে বিপ্লবী অনুশীলন দলে যোগ দেন এবং ১৯২৪ সালে বৈপ্লবিক কার্যকলাপের জন্য গ্রেপ্তার হন। আসামে প্রবাসী বাঙালিদের অধিকারের জন্য লড়াই করেছিলেন এবং ১৩ বার জেল খেটেছিলেন।

#আরও পড়ুন » ‘অনিন্দ্য রায় : আমি কি জল হয়ে যাব?’

১৯৩৭ সাল। চারিদিকে বিপর্যস্ত অবস্থা। একদিকে শুরু হয়ে গেছে দেশ বিভাগের চূড়ান্ত মহড়া আর তার ফলস্বরূপ চলছে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের বাকযুদ্ধ এবং হিন্দু-মুসলমানের লড়াই। আর এসবই তখনকার অখণ্ড ভারতের রাজনৈতিক মহলের যাকে বলে ‛হট টপিক’। আবার, এর সাথে পাল্লা দিয়ে অন্যদিকে আসামে শুরু হয়েছে অসম জাতীয়তাবাদের সূচনাপর্ব। সেখানে শুরু হচ্ছে বাঙাল খেদা আন্দোলন

এই অসহায় বাঙালির, বিপর্যস্ত বাঙালির তখন পরম ভরসা ছিল দরিদ্র দরদি, কৃষক দরদি, মজলুম দরদি এই মাওলানা ভাসানী। ওই সময় তিনি ছিলেন আসামের জনপ্রিয় কৃষক নেতা। সেই সময়ে তিনি মনে করেছিলেন যে, আসামের বাঙালি কৃষকদের সঙ্ঘবদ্ধ থাকা দরকার। আর তার ফলে তিনি বাঙালি কৃষকদের সঙ্ঘবদ্ধ করে গড়ে তুলেছিলেন ‛আসাম চাষী মজুর সমিতি’। ওই ১৯৩৭ সালেই, তিনি আসাম প্রদেশের ধুবড়ি দক্ষিণ কেন্দ্রে নির্বাচনে প্রার্থী হলেন এবং জিতলেনও। তাঁর স্থান হলো আসামের আইনসভায়।

⏩ Read More Post On Tune Of Life!

সেইসময়, আসাম আইনসভায় বেশ আভিজাত‍্যের রমরমা ছিল। এই অভিজাত‍্য ব্যক্তিদের সাথে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের সাথে তেমন কোনো সম্পর্ক ছিল না। সাধারণ মানুষের কথা কে শুনবে? তা শুনে বলবার মানুষ বলতে একজনই ছিলেন; আর তাঁর নাম মাওলানা ভাসানী। তিনি ছিলেন বলা যায় জনতার কণ্ঠস্বর― জনতার দাবি-দাওয়া, আবেগ সমস্ত কিছু ব্যক্ত করার এক মুখ।

আসলে, সাধারণ মানুষের কথা তিনি কেনই বা শুনবেন না? তিনি ছিলেন অত্যন্ত বাংলা ভাষা-দরদি এক ব্যক্তি। মাতৃভাষা বাংলার প্রতি ছিল তাঁর অগাধ, অকৃত্রিম ভালোবাসা। বাঙালি জাতির প্রত‍্যেকে ছিল যেন তাঁর ভাই বোন। মাতৃভাষা বাংলার প্রতি এই অকৃত্রিম আবেগ ও ভালোবাসার পরিচয় পাওয়া যায় যখন পরাধীন আমলে ভারতীয় জনপ্রতিনিধিরা সবাই ইংরেজিতে বক্তৃতা দিচ্ছেন; আর সেই অভিজাত মানুষদের মাঝে মাওলানা ভাসানী প্রতিবাদ করে গর্জে উঠে জানিয়ে দিলেন যে তিনি বাঙালি আর তাই তিনি তাঁর মাতৃভাষা বাংলাতেই বক্তৃতা দেবেন।

#আরও পড়ুন » টেকনিক্যাল বনাম অনপেইজ এসইও!

সেই সময় অর্থাৎ ইংরেজদের অধীনে পরাধীনতার যুগে বাংলা ভাষার তেমন কোনো গুরুত্ব ছিল না। মনে রাখতে হবে যে, মাওলানা ভাসানী হলেন প্রথম জনপ্রতিনিধি যিনি আইনসভায় বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দিতেন। তাই তিনি এত বাংলার গর্বের। তিনি দীর্ঘ ১১ বছর আসামের প্রাদেশিক আইনসভায় বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব করেন।

দেশ স্বাধীন হবার পরে আসাম বিধানসভায় যে বাংলা ভাষা স্বীকৃতি পেয়েছিল, তার পেছনেও মাওলানা ভাসানীর যথেষ্ট অবদান ছিল।

মওলানা ভাসানীর কাজের মতোই উল্লেখযোগ্য ছিল তাঁর ভাষণ বা বক্তৃতা। ওই ১৯৩৭ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর প্রজাস্বত্ব আইন বিষয়ক একটি বিতর্ক সভায় তিনি বলেছিলেন―

“দরিদ্র কৃষকদের প্রতি আমাদের বর্তমান ধনবাদী, সাম্রাজ্যবাদী গভর্নমেন্টের কোনো লক্ষ‍ই নাই। এখনো জমিদারের হাতে সার্টিফিকেটের ক্ষমতা রাখা হইয়াছে। সার্টিফিকেট দেওয়া মানে মেশিনগান দিয়ে খাজনা আদায় করা।”

সাধু ভাষায় তাঁর এই উক্তিটি তৎকালীন পরাধীনতার আমলে কৃষকদের করুণ চিত্রটি ফুটিয়ে তোলে। আর এর সাথেই ফুটে ওঠে গরিব কৃষকদের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম দরদ। তাঁর ভাসানী উপাধিরও ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে তাঁর এই কৃষক দরদির সাথে।

১৯৪২ সালে ভাসানীচরে ঐতিহাসিক কৃষক সম্মেলন সংগঠিত হয়। সেখানে তিনি তীব্র ভাষণ দেন। ভাষণের তীব্রতার জন্যে তাঁকে ‘ভাসানী’ উপাধি দেওয়া হয়।

কৃষক-দরদি মাওলানা ভাসানী ছিলেন একজন বিশিষ্ট রবীন্দ্র-অনুরাগী। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতোই তিনিও ছিলেন মাতৃভাষা বাংলা অন্তপ্রাণ। আর তার দরুন যখনই কোনো মাতৃভাষা বাংলা সংক্রান্ত আন্দোলন দেখা দিয়েছে, তখনই রাস্তায় মিছিলে দেখা গিয়েছে এই বাংলা ভাষা সৈনিককে।

দেশবিভাগের পর পূর্ব-পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ)-এর ১৯৪৮ সালে হোক কিংবা ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষা আন্দোলন; বাংলা ভাষা রক্ষার ব্যাপারে সর্বদাই রাস্তায় মিছিলে দেখা গিয়েছে তাঁকে। ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনের জন্য গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। তাঁর মাতৃভাষার প্রতি দরদ ছিল একেবারে নির্ভেজাল! কেন না আন্তর্জাতিক শান্তি সংহতি মঞ্চে বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে তিনি বাংলা ভাষার মর্যাদা বিশ্বের কাছে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।

#আরও পড়ুন » বিবর্তন

শুধু ভাষা আন্দোলন নয়, ১৯৪৯ সালে ঐতিহাসিক ভুখা মিছিলের পর তিনি গ্রেপ্তার হন এবং ১৯৫০ সালে অনশন ধর্মঘটের ফলে তিনি জেল থেকে ছাড়া পান। বিভিন্ন আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠেছিলেন তিনি।

আজ যখন আমাদের এই বাংলায় হিন্দি ও উর্দুর দাপট বাড়তে থাকে, যখন সরকারি পোষিত স্কুলে বাংলার পরিবর্তে উর্দু ভাষার শিক্ষক নিয়োগ করতে দেখা যায়; আর তার প্রতিবাদে বাংলা মায়ের দুই তরুণ সন্তানের প্রাণ যায়, কিংবা আমাদের এই বাংলায় বাংলা ভাষার গুরুত্ব ক্রমাগত কমতে থাকে, হিন্দি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে; তখন সত্যিই বলছি- মনটা বড়োই কেঁদে ওঠে আর ঠিক সেই সময়েই মনে পড়ে বাংলা ভাষার অন্যতম সৈনিক বা সেনাপতি মওলানা ভাসানীকে। বাংলা যে আমাদের মাতৃভাষা, প্রাণের ভাষা। আমরা যে বাঙালি। হে মাতৃভাষা সেনাপতি, লও সশ্রদ্ধ শত কোটি প্রণাম। আপনার মতো এক ভাষা সেনাপতির কথা, বাঙালি জাতির কখনো ভুলবে না!

প্রবন্ধ: এক ভাষা সেনাপতির কথা!

লেখক: ইন্দ্রনীল মজুমদার

সম্পাদক: আবুল হাসনাত বাঁধন

[কিওয়ার্ডস: প্রবন্ধ, আবুল হাসনাত বাঁধন, এক ভাষা সেনাপতির কথা | ইন্দ্রনীল মজুমদার, এক ভাষা সেনাপতির কথা – ইন্দ্রনীল মজুমদার, এক ভাষা সেনাপতির কথা : ইন্দ্রনীল মজুমদার, এক ভাষা সেনাপতির কথা, ইন্দ্রনীল মজুমদার, নিবন্ধ]

Share With Love:

মন্তব্য করুন: